সৈয়দ মাজহারুল পারভেজ :১৯৯০ সাল থেকে কলকাতায় যাচ্ছি। তবে, এবারের কলকাতায় যাওয়াটা ছিল একেবারেই অন্যরকম। আমি সাধারণত ভ্রমণ কাহিনি লিখি না। অনেকেই ফেসবুকে, মেসেঞ্জারে এবং ফোনে এবারের ভারত সফরটাকে নিয়ে লিখতে বলছেন। সে কারণেই, এবার লিখছি। তার সাথে আমার নিজেরও ইচ্ছে ছিল, বিভিন্ন কারণে এবারের ভারত ভ্রমণ অভিজ্ঞতাটা লিখবো।
তখন ঢাকার একুশে বইমেলা চলছে। বইমেলার পরে ৩, ৪ ও ৫ মার্চ কবি নজরুলের নাতনি সোনালী কাজীর আয়োজনে কবিবন্ধু বিধানেন্দু পুরকাইতের আমন্ত্রণে বর্ধমানের চুরুলিয়ায় কাজী নজরুল ইসলামের বাড়িতে দোলনচাঁপার তিন দিন ব্যাপী অনুষ্ঠানে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিশেষ কারণে অনুষ্ঠানটি স্থগিত হয়ে যায়। ঠিক এ সময়ে কলকাতার (কল্যাণী) উদার আকাশ পত্রিকার সম্পাদক কবি ফারুক আহমেদ আমাকে ফোন করলেন। তিনি বললেন- আপনার ভারতের ভিসা আছে তো?
আমি বললাম- হ্যা, আছে।
ফারুক বললেন- মার্চের ২৩ ও ২৪ তারিখে বহরমপুর গার্লস কলেজের একটা অনুষ্ঠানে আপনাকে আসতে হবে। আমি ওদেরকে বলে দিয়েছি। আমি ওদেরকে আপনার ফোন নং দিয়ে দিয়েছি। ওরা আপনাকে ফোন করবে। না করলে চলবে না।
ফারুক আহমেদ আমার অত্যন্ত প্রিয় এবং স্নেহধন্য একজন মানুষ। তাকে নিয়ে এর আগেও অনেকবার লিখেছি। তিনি যখন ক্লাশ এইটে পড়েন তখন থেকেই আমার ‘ভালোবাসা কারে কয়’, ‘এরই নাম প্রেম’, ‘মন ভালো নেই’, ‘একটু ভালোবাসার জন্যে’, ‘কফি হাউসের আড্ডা’সহ কলকাতা ও ঢাকা থেকে প্রকাশিত আরো অনেক উপন্যাস পড়ে তখন থেকেই আমার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত হয়ে যান। এখন তিনি নিজেই একজন বড় মাপের কবি, লেখক, প্রাবন্ধিক এবং সম্পাদক। উদার আকাশের মতো একটি পাঠকপ্রিয় পত্রিকার সম্পাদক। যেখানে ভারত-বাংলাদেশের সমৃদ্ধ কবি-লেখকেরা নিয়মিত লিখছেন।
ফারুক আহমেদ এমন একজন মানুষ যাকে আমার না বলার উপায় নেই। এতোটা দাবি নিয়ে কথা বলেন যে আমি কোনো কিছুতেই না করতে পারি না। সুতরাং তিনি যখন বলেছেন তখন আমাকে তো যেতেই হবে। কিন্তু একটাই সমস্যা, মার্চের ২৩ ও ২৪ তারিখে রোজা শুরু হবে। আমি আমার গোটা জীবনে কখনও পরিবারকে ছাড়া প্রথম ইফতারি করিনি। এবার করতে হবে। তারপরও না গিয়ে উপায় নেই। ফারুকের বিষয় বলে কথা!
এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ফারুক আহমেদ এবং আমি মুর্শিদাবাদে দ্বি-দিবসীয় হাজারদুয়ারী কবিতা উৎসবে গিয়েছিলাম। সেবার ইচ্ছে থাকলেও সময়ের অভাবে খুব বেশি ঘুরে দেখা হয়নি। দু’ঘন্টায় এ্যাট এ গ্লেন্স আমরা মুর্শিদাবাদ ঘুরে দেখেছিলাম। সেবার মুর্শিদাবাদ থেকে আরেকটি অনুষ্ঠানে ভগবানগোলায় যাই। ভগবানগোলায় খাওয়া স্পেশাল বিফ এখনও মনে দাগ কেটে আছে। ভাবলাম, এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে আরেকবার মুর্শিদাবাদ-বহরমপুর ঘুরে দেখা যাবে। সে কারণেও আমি সাথে সাথে রাজি হয়ে গেলাম।
মুর্শিদাবাদ বা বহরমপুরে যাওয়ার আরো একটি কারণ রয়েছে। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন এই মুর্শিদাবাদের পলাশির আমবাগানে এক প্রহসনের যুদ্ধে আমরা আমাদের স্বাধীনতা হারিয়েছিলাম। যা ফিরে পেতে আমাদের ২১৪ বছর কেটে যায়। এ বিষয়ে আমার ‘পলাশি থেকে মুজিবনগর : ইতিহাসের কালো অধ্যায়’ বইতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
যথারীতি বহরমপুর গার্লস কলেজ থেকে ফোন এলো। ফোন করলেন বহরমপুর গার্লস কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মধু মিত্র। তিনি প্রোগ্রামটির মূখ্য অর্গানাইজার। তিনি অনুষ্ঠানটির বিষয়ে জানালেন। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম সাহিত্য অনুষ্ঠান বা পুরস্কার বিতরণী গোছের একটা কিছু। কিন্তু এটা সে ধরণের অনুষ্ঠান ছিল না। এটি মার্চের ২৩ ও ২৪ তারিখ দুই দিনের একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের বিষয়- ‘শিকড়ের খোঁজে : বিশ শতকের সাহিত্য ও সংস্কৃতি’। তখন বিষয়টি পুরোটা না বুঝলেও পরে বুঝেছিলাম। এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে থাকতে হবে। বাংলাদেশ থেকে বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন (সেলিনা আপা) প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। এই বিষয়ের একটি স্মরণিকা এবং প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হবে। সেই স্মরণিকা এবং প্রবন্ধ সংকলনে লেখাও দিতে হবে। দুই দিনের অনুষ্ঠানে প্রায় দু’শো লেখকের প্রবন্ধ উপস্থাপিত হবে। যা উপস্থাপনকারির চাকরির ক্ষেত্রে বিশেষ কাজে দেবে। যারা প্রবন্ধ উপস্থাপন করবেন তারা সকলেই ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের ও বাংলাদেশের বিভিন্ন কলেজের স্বনামধন্য অধ্যাপক হিসেবে চাকরিরত আছেন। যাদের অধিকাংশই পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এমন একটি অনুষ্ঠানে অতিথি হওয়া তো ভাগ্যের ব্যাপার। এ অনুষ্ঠান মিস করতে মন চাইল না। ফলে, কথা দিয়ে দিলাম।
এরপর শুরু হয়ে গেল ভারত সফরের মানসিক প্রস্তুতি। অধ্যাপক ড. মধু মিত্র সবসময় যোগাযোগ রাখছেন। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই ফোন করছেন, আপডেট জানাচ্ছেন। তিনি ঢাকা-কলকাতা বিমানের টিকিট পাঠাতে চেয়েছিলেন। আমি না করেছিলাম। কেননা, হাতের কাজ-টাজ শেষ করে আমি কবে যাব সেটাই ঠিক করতে পারছিলাম না। আমি বললাম- আপনাকে পাঠাতে হবে না। আমি টিকিট করে নেব। তিনি ট্রেনে কলকাতা থেকে বহরমপুরের যাওয়া এবং আসার ফার্স্ট ক্লাশের টিকিট পাঠিয়ে দিলেন। আমি যথারীতি বাংলাদেশ বিমানের একটা টিকিটও করে ফেললাম। ২১ তারিখ সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট। পরদিন ২২ মার্চ কলকাতায় কিছু কাজ সারবো বলে ২১ তারিখের টিকিট করেছিলাম। রাতে কলকাতায় বুদ্ধ ধর্মাংকুর সভায় থাকবো বলে কবি অমলেন্দু চৌধুরীকে বলে রেখেছিলাম। তিনি সে মোতাবেক ব্যবস্থাও করেন।
ঢাকা থেকে রাত পৌনে আটটায় ফ্লাইট। জ্যামের শহর বলে আমি ছ’টার আগেই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে পৌঁছে গেলাম। কিন্তু বিধি বাম! গিয়ে জানলাম ফ্লাইট লেট। প্রায় দেড় ঘন্টা। যাওবা তিনি এলেন কিন্তু ধীর গতির কারণে চল্লিশ মিনিটের পথ গেলেন প্রায় দেড় ঘন্টায় কলকাতায় গেলেন। বাংলাদেশ বিমান বলে কথা! দমদম এয়ারপোর্টে ঘটলো আরেক বিড়ম্বনা। টুরিস্ট ভিসায় সেমিনারে যাচ্ছি শুনে দমদম ইমিগ্রেশন আটকে দিল। তারা বললো- ট্যুরিস্ট ভিসায় সেমিনারে যাওয়া যাবে না।
আমি বললাম- আমার তো সেমিনার ভিসা নেই। আমাকে এখন কী করতে হবে?
তারা বললো- স্যার, আপনি এই চেয়ারটায় একটু বসুন। আমাদের অফিসারের সাথে কথা বলে দেখি।
অফিসার তখন সিটে ছিলেন না। অনেকক্ষণ পর এলেন। তখন আমার অফিসারের রুমে ডাক পড়লো। অফিসার বিনয়ের সুরে বসতে বললেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, ট্যুরিস্ট ভিসায় যে সেমিনারে আসা যায় না আমি সেটা জানি কিনা।
আমি বললাম- অনেকেই ট্যুরিস্ট ভিসায় সেমিনারে আসছে। তারা হয়তো সেটা বলছে না। আমি সত্যি কথা বলেছি এটাই আমার অপরাধ। ট্যুরিস্ট ভিসায় সেমিনারে না আসা যায় আমি সেমিনারে যাব না। আমি তো এম্নি এম্নি আসিনি। আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে আনা হয়েছে। ওকে আমি কাল সকালেই ঢাকায় চলে যাব।
এ কথা শুনে অফিসার আমার দিকে একটু তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বললেন- ঠিক আছে, এবারের মতো যান। এরপর সেমিনারে এলে সেমিনার ভিসা করে আসবেন। নইলে আবার ইমিগ্রেশন আটকে দেবে।
দমদম এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে রাত প্রায় বারটা বেজে গেল। বাইরে আসতেই প্রচুর ট্যাক্সি মিলল। একটা ট্যাক্সি নিলাম। এতো রাতে ভাড়া কমই নিল। ৫০০ রুপি। দিনে হলে ৩০০/৩৫০ রুপিতে যাওয়া যেতো। আমার গন্তব্য বৌবাজার। রাস্তা ফাঁকা থাকায় কম সময়ে বৌবাজারের বুদ্ধ ধর্মাংকুর সভায় পৌঁছে গেলাম। ম্যানেজার রাজিব রাসায় চলে গেছে। গেটম্যান অজিত দাস তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। তাকে জাগাতে খানিকটা বেগ পেতে হলো। তাড়াহুড়োয় রাতে খাওয়া হয়নি। অজিত দাসও আমি ঢুকতেই আবার গেট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়লো। আমি রাতে খাইনি শুনে বুদ্ধ ধর্মাংকুরের এক স্টাফ চানাচুর, মুড়ি, নাড়ু ও মেরি বিস্কুট দিয়ে গেল। সেটা খেয়ে রাতে শুয়ে পড়লাম।
কিন্তু একটা বিপত্তি দেখা দিল। সিম কাজ করছে না। ডিসেম্বরে যখন যাই তখন আনোয়ার আলি মোল্লা নামে এক প্রিয়জন আমাকে একটা সিম দেন। আমি কলকাতায় গেলে তিনি সবসময় আমার জন্য আগে থেকে একটা সিম তুলে রাখেন। সেটা কাছে ছিল। ছড়াকার সোহেল মল্লিকের সিমটাও সাথে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু রিচার্জ না করলে কোনটাই কাজ করছে না। পরদিন আমার সিমটা রিচার্জ করলাম। কিন্তু দেখা গেল আমি আমার ২০১৫ সালের সিমটা রিচার্জ করে ফেলেছি। আর- আমি ভুলে ডিসেম্বরের সিম না নিয়ে অন্য একটা সিম নিয়ে গিয়েছি। ফলে, আমার তিনশো টাকা গচ্ছা গেল। এরপর সোহেল মল্লিকের সিমটা রিচার্জ করলাম। ফোন রিচার্জ করার পর খানিকটা আশ্বস্থ হলাম।
এরপর সকালের নাস্তার পালা। বৌবাজারে অনেকগুলো মুসলিম হোটেল আছে। যেখানে ১৫/২০ আইটেমের ফ্রেস বিফ পাওয়া যায়। কলকাতায় এলেই প্রচুর বিফ খাই। কারণ, এখানে ফ্রেস বিফ পাওয়া যায়। যখন নানরুটি আর বিফ কারি দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করছি ঠিক সে সময় কৌশিক মজুমদার ফোন করলেন। তিনি একজন স্বনামধন্য ভারতীয় বাঙালি রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী ও সাধক। অত্যন্ত সজ্জন মানুষ। তিনি বললেন- দাদা, আপনি এখন কোথায়?
আমি বললাম- নাস্তা করে রুমে যাচ্ছি।
তিনি বললেন- ওখানেই (বুদ্ধ ধর্মাংকুর সভায়) আছেন তো?
এর আগে ডিসেম্বরে এই বুদ্ধ ধর্মাংকুর সভায় বাংলাদেশ লেখক পরিষদের আয়োজনে ঢাকা-কলকাতা সাহিত্যে উৎসব করেছিলাম। তিনি সে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
আমি বললাম- হ্যা, ওখানেই উঠেছি।
তিনি বললেন- আপনি রুমে থাকুন। আমি দশ মিনিটের মধ্যে আপনার রুমে আসছি।
দশ মিনিট নয়, মিনিট বিশেকের মধ্যে তিনি চলে এলেন। রুম ছেড়ে দিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আমার সাথে ভারতীয় রুপি ছিল না। আমি একটা ভুল করেছিলাম। ঢাকা থেকেই ভারতীয় কারেন্সি নিয়ে যেতে পারতাম। কলকাতায় রেট আরো কম। টাকা একচেঞ্জ করার জন্য আমরা প্রথমে মেট্টোতে করে চাদনী চক থেকে এসপ্লানেডে এলাম। এদিন দুপুরে কলকাতার বরেণ্য কবি অলোক দাশগুপ্ত’র বাসায় খাওয়ার কথা ছিল। প্রোগ্রামটি ঢাকা থেকেই করা ছিল। সব অয়োজন করাও ছিল। কিন্তু একা যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। কৌশিক বাবুকে বিষয়টি বললাম।
আমাদের দেশে একজনের দাওয়াত থাকলে তার সাথে দু’পাঁচজন যাওয়া কোন ব্যাপারই না। কিন্তু কলকাতায় দাওয়াত ছাড়া কেউ যেতে চান না। তাই কৌশিক বাবুও রাজি হলেন না। তাছাড়া তিনি আমাকে না বলেই তার বাসায় দুপুরের খাবারের আয়োজন করে এসেছেন। দুপুরে তার বাসায় খেতে হবে। অলোক দাকে কোনভাবে ম্যানেজ করে আবার মেট্টো ধরে বেলগাছিয়ায় কৌশিক বাবুর বাসায় চলে গেলাম।
সন্ধ্যে ছটা কুড়িতে আমার বহরমপুরের ট্রেন। মধু বাবু আগেই ফার্স্ট ক্লাশে ট্রেনের টিকিট করে রেখেছেন। হাতে তখনও ঢের সময় রয়েছে। তারপরও কৌশিক বাবুর বাসা থেকে তিনটের দিকে বেরিয়ে পড়লাম। বেলগাছিয়া থেকে কলেজ স্ট্রিট। কলেজ স্ট্রিটে এসে অধীর দার (বরেণ্য লেখক, সাংবাদিক ও প্রকাশক; গাঙচিল প্রকাশনীর কর্ণধার) সাথে দেখা করলাম। তিনি আমার একটা বই প্রকাশ করছেন। সেটার খবর নিলাম। সব কাজ শেষ। এই এপ্রিলেই বের হবে।
সেখান থেকে কফি হাউজে গেলাম। গাঙচিল থেকে কফি হাউজ মিনিট তিনেকের হাঁটা পথ। কফি হাউজে যাওয়ার জন্যেই কলেজ স্ট্রিটে আসা। তাছাড়া এখান থেকে শেয়ালদা ওয়াকিং ডিসট্যান্স। কলকাতায় আসবো আর কফি হাউজে যাব না সেটা কী হয়! এই কফি হাউজ নিয়ে আমার একটা উপন্যাস আছে। উপন্যাসটি লেখার সময় অসংখ্যবার কফি হাউজে এসেছি। তখন থেকেই একটা নেশা হয়ে গেছে। কলকাতায় এসে কফি হাউজে না এলে মনটা খচখচ করে। তাড়া ছিল বলে কফি হাউজে এক কাপ কফি খেয়ে খানিকটা আড্ডা মেরে খানকতক ছবি তুলে শেয়ালদার পথ ধরলাম।
কলেজ স্ট্রিটে আসার আরো একটি কারণ ছিল, সেটা হলো ফুটপাতে পুরোনো বই দেখা। কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাতে অনেক পুরনো ও দরকারি বই পাওয়া যায়। এর আগেও আমি অনেক বই কিনেছি।
ছ’টা কুড়ির ট্রেন। ভাগীরথী এক্সপ্রেস। অধ্যাপক ড. মধু মিত্র আগেই টিকিট করে রেখেছিলেন। তিনি টাইম-টু-টাইম খবর নিচ্ছিলেন। বহরমপুর রেলস্টেশনে তিনি অপেক্ষা করবেন সেটাও জানালেন। অন্ধকারে বাইরে কিচ্ছু দেখা যায় না। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে ট্রেনেই খানিকটা ঘুমিয়ে নিলাম।
লাইনে কাজ চলছিল বলে ট্রেন পৌঁছতে আধঘন্টা লেট হলো। বহরমপুর পৌঁছতে রাত ১১টা বেজে গেল। মধু বাবু গাড়ি নিয়ে স্টেশন গেটে অপেক্ষায় ছিলেন। এর আগে কখনও তার সাথে দেখা হয়নি। কিন্তু তিনি বাংলাদেশ লেখক পরিষদের ব্যাগ দেখে ঠিক ঠিক চিনে ফেললেন। এই ট্রেনে আরো একজন আমন্ত্রিত আলোচক ছিলেন। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সঞ্জিত মণ্ডল। মধু বাবু পরিচয় করিয়ে দিলেন। খুবই সজ্জ্বন মানুষ। আমাদেরকে নিয়ে গাড়ি চললো বহরমপুর সার্কিট হাউজের দিকে। গাড়িতে যেতে যেতে আমাদের তিনজনের অনেক কথা হলো। অধ্যাপক ড. মধু মিত্রকে দেখে একবারও মনে হয়নি আগে কখনও দেখা হয়নি। প্রথম দেখাতেই মনে হয়েছে, কতো দিনের চেনা- কতো আপন। অধ্যাপক ড. সঞ্জিত মণ্ডলও ছিলেন প্রাণবন্ত। কথা বলতে বলতে কখন যে আমরা বহরমপুর সার্কিট হাউজে পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারিনি।
রাতের খাবার আগেই রুমে দেয়া ছিল। সার্কিট হাউজে আমাদের আরো কিছুক্ষণ আড্ডা হলো। মধু বাবু চলে যাবার পর খেয়ে শুয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠলাম। সেভ-গোছল করে নাস্তা খেয়ে রেডি হয়ে অপেক্ষা করলাম। বহরমপুর গার্লস কলেজের ইংরেজির অধ্যাপক ইকবাল আনসারী এবং আরো একজন অধ্যাপক অনুষ্ঠানে নিয়ে যাবার জন্য আমার রুমে এলেন। মধু বাবুর গাড়িতেই গেলাম। ওনার গাড়িটা আমাদের ফুলটাইম সার্ভিস দিয়েছে। যখন যেখানে যাওয়ার কোন অসুবিধা হয়নি। কলেজের অনুষ্ঠানে সেলিনা আপা এবং ওনার স্বামী আনোয়ার হোসেন খানের সাথে দেখা হলো। অনেক রাতে গিয়েছিলাম বলে রাতে দেখা করিনি। আপা এই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছেন।
বহরমপুর গার্লস কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রোগ্রামটির মূখ্য অর্গানাইজার ড. মধুমিত্র এবং একই কলেজের অধ্যাপক ড. সুতপা মুখোপাধ্যায়ের চমৎকার ও প্রাণবন্ত উপস্থাপনায় যথা সময়ে অনুষ্ঠান শুরু হলো। এদিনের অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করার কথা ছিল কলেজের পরিচালনা কমিটির চেয়ারম্যান শ্রী নাড়ুগোপাল মুখার্জির। তিনি আসতে দেরি করায় কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হেনা সিনহার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান শুরু হয়। আমি ছাড়াও একে একে মঞ্চে আসন গ্রহণ করলেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. রূপকুমার বর্মণ, কন্যাশ্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মিতা ব্যানার্জি, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. সঞ্জিত মণ্ডল। (আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. তপোধীর ভট্টাচার্যর উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তিনি অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি)। মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. রূপকুমার বর্মণের সাথে সকালেই সার্কিট হাউজে দেখা হয়েছিল। চমৎকার আলাপী এবং প্রাণবন্ত মানুষ। আমাকে দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। নিজে উঠে এসে কুশল বিনিময় করলেন। প্রথম আলাপেই মুগ্ধ হলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. হেনা সিনহা স্বাগত বক্তব্য রাখেন। অতিথিদেরকে ফুল ও উত্তরীয় দিয়ে বরণ শেষে একটি চমৎকার কবি ব্যাগ এবং সুদৃশ্য ময়ূরপঙ্খী উপহার দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানের সভাপতি অধ্যাপক ড. হেনা সিনহার পর একে একে অতিথিবৃন্দ তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। আমি আমার বক্তব্যে নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা ছাড়াও ভারতীয় বাঙালি এবং বাংলাদেশের বাঙালিদের ভাষা নিয়ে কথা বললাম। একই বাঙালি হয়ে আমাদের লেখা ভিন্নরকম। যার কারণে আমাদের বই যখন কলকাতা, আসাম বা আগরতলায় ছাপা হয় এবং ভারতীয় লেখকদের বই যখন বাংলাদেশে ছাপা হয় তখন অনেকরকম সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিশ্বায়নের যুগে এটা নিরসনকল্পে কথ্য ভাষা যার যার মতো হলেও লেখার ভাষা একরকম হওয়া দরকার মলে আমি মনে করি। তাতে করে বাংলা ভাষা আরো পরিশীলিত হবে বলে আমি মনে করি। এর জন্য ভারত এবং বাংলাদেশ সরকারকে যৌথভাবে উদ্যোগ নিতে হবে।
আমার এই বক্তব্য সকলের মনে বেশ প্রভাব ফেলে। লাঞ্চ ব্রেকে উপস্থিত ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা আমার কাছে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চান। আমি তাদেরকে বিষয়টি সবিস্তারে ব্যাখ্যা করি।
এদিনের প্রধান অতিথি ছিলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয় সেলিনা আপা। আপা বাংলাদেশ ও ভারতের বিাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। সেলিনা আপার বক্তব্যের পর প্রথম অধিবেশন শেষ হয়। প্রথম অধিবেশন শেষে লাঞ্চ ব্রেক। লাঞ্চের কথা না হয় নাই বললাম। রাইস, প্লেন পোলাও, নানরুটি, ভেজিটেবল, রোস্ট, রেজালা, ভারতের কিছু কমন খাবার, দই-মিষ্টি কিছুই ছিল না। আমরা সকলেই পেট পুরে তৃপ্তি সহকারে খেলাম। তবে, বহরমপুরের মিষ্টির কথা বলতেই হবে। বিশেষ করে রসগোল্লাটা আমার খুব ভালো লেগেছে। যদিও আমরা রসগোল্লার দেশের মানুষ। আমাদের যশোরের সাদেক গোল্লা এবং স্পঞ্জের রসগোল্লা পৃথিবী বিখ্যাত।
দ্বিতীয় অধিবেশনটা ছিল অধ্যাপকদের সন্দর্ভ পাঠের। কয়েকটি ভাগে ভারতের কয়েকটি রাজ্যের এবং বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অধ্যাপকেরা তাদের সন্দর্ভ-নিবদ্ধ পাঠ করলেন। সেলিনা আপা রুমে চলে গিয়েছিলেন। আমি একটি সেসনের চেয়ার (সভাপতিত্ব) করলাম।
রাতে ড. মধু মিত্র, ড. মোস্তাক আহমেদ, তন্ময় মুক্তাদিরসহ গঙ্গার ধারে অনেক রাত পর্যন্ত জম্পেস আড্ডা হলো। ড. মধু মিত্র ও ড. মোস্তাক আহমেদ দুজনেই জমিয়ে আড্ডা দিতে পারেন। আড্ডা যেন শেষই হতে চায় না। কিন্তু ফেরার সময় ঘটলো এক কাণ্ড। আমরা সার্কিট হাউজের দারোয়ানকে বলে যায়নি। আমাদের ফিরতে রাত বারোটার বেশি বেজে গেল। আমরা এসে দেখি, সার্কিট হাউজের গেট বন্ধ। অনেক ডাকাডাকিতেও কাজ হলো না। ভাগ্যিস তন্ময়ের স্ত্রী সার্কিট হাউজের ভেতরে ছিল। তন্ময় তাকে ফোন দেবার পর দারোয়ান এসে গেট খুলে দিল।
পরদিন খুব সকালে মধু বাবু হাঁটতে যাবার জন্য ফোন দিলেন। আমাদের আগের রাতেই হাঁটতে যাওয়া নিয়ে কথা হয়েছিল। আমি আগেই রেডি হয়ে ছিলাম। পলাশির যুদ্ধের পর বহরমপুর ইংরেজদের ব্যারাক ছিল। মোড়ে মোড়ে ইংরেজদের নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে। বহরমপুরের প্রচুর গ্র্রাউন্ডকে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সার্কিট হাউজের পেছনেই একটা বিশাল গ্রাউন্ড রয়েছে। প্রচুর মানুষ সকাল-বিকাল এখানে হাঁটে। এখানেই I Love Berampur লেখা। এখানে অনেকেই ছবি তোলে। আমরাও তুললাম। মাঠের চারদিকে পলাশির যুদ্ধের চারটি কামান রয়েছে। সেগুলোকে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
হাঁটা শেষে মধুবাবু আমাকে কে এন (কৃষ্ণনাথ কলেজ) কলেজে নিয়ে গেলেন। অত্যন্ত প্রাচীন কলেজ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে ১৮৫৩ সালে এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশাল জায়গা জুড়ে কলেজটি প্রতিষ্ঠিত। জমিদার কৃষ্ণ নাথ এই কলেজটি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি একজন শিক্ষা সংস্কারক জমিদার ছিলেন। অনেকেই আশা করেছিলেন, মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়টি তার নামে নামকরণ করা হবে। কিন্তু সেটা হয়নি। কে এন কলেজের ভেতরে অনেক ছবি তোলার স্পট রয়েছে। আমি নাগলিঙ্গম এবং কিছু ফুলের সাথে ছবি তুললাম। মধু বাবু তুলে দিলেন। কলেজের সাথেই গঙ্গা ঘাট। মনোরম পরিবেশ। আগের দিন রাতে এসেছিলাম। ঠিক বোঝা যায়নি। রাতের গঙ্গা আর দিনের গঙ্গার ভেতর অনেক ফারাক। এটাকেই ভাগীরথী নদী বলে। যে নদী থেকে নবাব সিরাজ উদ দৌলা মীর কাশিমের সৈন্যদের হাতে গ্রেফতার হবার পর মীর জাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে মৃত্যুবরণ করেন।
আমরা দুজনে গঙ্গার ঘাটে কিছুক্ষণ বসলাম। অত:পর আবার মাটির ভাড়ে চা খেয়ে সার্কিট হাউজে ফিরে এলাম। সেই ১৯৯০ সাল থেকে কলকাতা বা পশ্চিমবঙ্গে যতোবার এসেছি ততবারই মাটির ভাড়ে চা খেয়েছি এবং ছবি তুলেছি। এমন কী এবারে আগরতলায়ও খুঁজে বের করে মাটির ভাড়ে চা খেয়েছি। সার্কিট হাউজে ফিরে মধু বাবুসহ সেলিনা আপার রুমে দীর্ঘ আড্ডা হলো। সেলিনা আপা এবং আপার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খান এবং মধু বাবুসহ চারজন একসাথে সেলিনা আপার রুমে সকালের করলাম।
এদিন সকাল দশটায় যথারীতি দ্বিতীয় দিনের অধিবেশন শুরু হলো। এদিন সভাপতিত্ব করলেন বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন। আমন্ত্রিত অতিথি বক্তা হিসেবে আমি মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের আবদুল কাফি, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মোস্তাক আহমেদ, গৌরমোহন শচীন মণ্ডল কলেজের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. নির্মাল্য কুমার ঘোষ। তাদের প্রাণবন্ত আলোচনা সকলকে মুগ্ধ করে। আর- প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. হেনা সিনহার সাথে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন বহরমপুর গার্লস কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং প্রোগ্রামটির মূখ্য অর্গানাইজার ড. মধুমিত্র এবং অধ্যাপক ড. । যথারীতি লাঞ্চ ব্রেক। একই রকমের ভূরি ভোজের পর শুরু হয় সেকেন্ড সেসন। এদিনও অধ্যাপক-প্রভাষকেরা তাদের সন্দর্ভ-নিবদ্ধ পাঠ করলেন। এদিনও আমি একটি সেসনের চেয়ার (সভাপতিত্ব) করলাম।
অনুষ্ঠান শেষে সার্কিট হাউজে ফেরার পর মধু বাবু বললেন- চলুন এটু চা-টা খাওয়া যাক। আমরা যখন চা খাচ্ছি ঠিক তখন বহরমপুরের কবি ও সাংবাদিক রাজীব ঘোষ এলেন। নামকরা কবি এবং সাংবাদিক। সব সময় নামে ওর নিজের একটা টিভি চ্যানেল আছে। ২০১৯ সালে আমি ও ফারুক আহমেদ যখন মুর্শিদাবাদে হাজার দুয়ারি কবিতা উৎসবে গিয়েছিলাম ফেরার পথে রাজীব ঘোষ তার গাড়িতে করে আমাদেরকে বহরমপুর রেলস্টেশন অবধি নিয়ে এসে ট্রেনে তুলে দিয়েছিলেন। আমি বহরমপুর এসেছি শুনে তিনি দেখা করতে আসেন। সার্কিট হাউজের ক্যান্টিনেই অনেকক্ষণ গল্প হলো। এরপর আমরা সেলিনা আপার রুমে গেলাম। সেখানেও অনেকক্ষণ গল্প হলো। এরপর ছবি তুলে বিদায় নিলেন রাজীব ঘোষ। আমি আর মধু বাবু থেকে গেলাম। আমাদের আরো অনেকক্ষণ কথা হলো।
সেলিনা আপাকে এভাবে কাছ থেকে দেখা হয়নি। অত্যন্ত নরম মনের মানুষ। সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলেন। এই বহরমপুরেই আপার জন্ম। সে কারণে এই জায়গাটার প্রতি আপার একটা অন্যরকম টান রয়েছে। পরদিন বাংলা একাডেমির স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান আছে জেনেও তিনি এসেছেন। সেলিনা আপার স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন খানও একজন চমৎকার এবং আড্ডাপ্রিয় মানুষ। ফলে, উঠি উঠি করেও আরো কিছুক্ষণ আড্ডা হলো।
এখানে অধ্যাপক ড. মধুমিত্র সম্পর্কে একটু বলতেই হবে। অত্যন্ত করিৎকর্মা ও প্রাণবন্ত একজন মানুষ। এই আলোচনা চক্রটি তারই উদ্যোগে সম্পন্ন হয়। একটুও ফুরসৎ নেই। সব কাজে সবার আগে তিনি আছেন। তাকে প্রয়োজনীয় সহায়তা করে যাচ্ছেন তাদের প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. হেনা সিন্হা। অধ্যাপক পাপিয়া ব্যানার্জি, অধ্যাপক ড. গীতা মণ্ডল, অধ্যাপক ড. খায়রুল আলম, অধ্যাপক ড. খয়বর আলি মিঞা, ড. ভাস্কর মহানায়ক-সহ কলেজের সিনিয়র ও জুনিয়র অধ্যাপক-প্রভাষক (এখানে হয়তো সবার নাম উল্লেখ করা গেল না) এবং ছাত্রীরা। অধ্যাপক সমীর বরণ দত্তসহ অবসরে যাওয়া অনেক শিক্ষকরাও অনুষ্ঠানে এসেছিলেন। এমন একটি টিম কম্বিনেশন খুব কমই দেখা যায়। এর জন্য বিশেষভাবে কৃতিত্ব দিতে হয় প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. হেনা সিনহাকে। তিনি স্নেহ-ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা দিয়ে সবাইকে এক সূতোয় বেঁধে রেখেছেন। এটা আমাকে বিশেষভাবে মুগ্ধ করেছে।
সব মিলিয়ে বহরমপুরে চারটে দিন (২২ তারখি রাত থেকে ২৫ তারিখ সকাল) অসাধারণ কাটলো। এবার ফেরার পালা। মধু বাবু আরো কয়েকদিন থাকার জন্য বলেছিলেন কিন্তু আমি থাকিনি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আমি কোথায় যেতে চাই। ঢাকায় না আগরতলায়। আগরতলায় বইমেলা হচ্ছে। সে কারণে, আমি আগরতলার কথা বললাম। আগের দিন বলে প্রায় চার গুণ টাকা দিয়ে আগরতলার টিকিট কাটলেন মধু বাবু। টিকিটের সাথে আমার যাওয়ার টিকিটের টাকার একটি খাম এবং আরো একটি খামও হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি নিতে চাইলাম না। কিন্তু তিনি শুনলেন না। জোর করে গছিয়ে দিলেন। অনেকে অনেক কিছু শুভেচ্ছা উপহার দিলেন। প্রিন্সিপাল অধ্যাপক ড. হেনা সিনহাও আমাকে একটা আমার পছন্দের পাঞ্জাবী এবং পাজামা গিফট করলেন। আরো অনেকে তাদের বই উপহার দিলেন। মধু বাবু তার মূল্যবান গ্রন্থ একুশ শতকের বাংলা ও বাঙালি, দর্পনে উনিশ শতক : ফিরে দেখা, রাজনীতি যুক্তিবাদ ধর্ম স্বাধীনতা উত্তর বাংলা’ বই তিন খানা উপহার দিলেন। কুণালকান্তি দে দিলেন তার ‘ভারতের প্রথম বইমেলার ইতিবৃত্ত’। আরো অনেকে তাদের বই দিলেন। আমার খুব লজ্জা লাগলো, আমি তো ওনাদের জন্য কিছুই নিতে পারিনি। এমন কী লাগেজ ভারী হবে বলে আমি ওনাদের জন্য বইও নিতে পারিনি। বিদেশের এই এক সমস্যা। লাগেজ টানা খুব কষ্ট।
পরদিন ২৫ মার্চ সকালে মধু বাবুসহ আবার বহরমপুর স্টেশনে এলাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। মাত্র এটুকু সময়ের মধ্যে মধু বাবুর সাথে একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। আবার সেই ভাগীরথী এক্সপ্রেসে চেপে কল্যাণী এলাম। ট্রেনে সহযাত্রী ছিলেন বহরমপুর গার্লস কলেজের একজন লেডি অধ্যাপক এবং প্রফেসর ডা. দিলীপ কুমার প্রধান এবং প্রফেসর ডা, অভিরূপ বন্দোপাধ্যায়ের সাথে গল্পে গল্পে কখন যে রানাঘাট চলে এলাম বুঝতেই পারিনি। এর আগে ট্রেন কৃষ্ণনগরে আসার আগে প্রফেসর ডা. অভিরূপ বন্দোপাধ্যায় বললেন- কৃষ্ণনগরের লুচি এবং আলুর দম ভেরি স্পেশাল। আমার খেতে খুব ইচ্ছে হচ্ছে। তবে, আপনি যদি খান দুজনে একসাথে খেতে পারি।
আমি সাধারণত জার্নিতে কিছু খাই না। কিন্তু ডা. অভিরূপ বাবুকে না করলাম না। তিনি নিজে ট্রেন থেকে নেমে গিয়ে লুচি এবং আলুর দম নিয়ে এলেন। সত্যি খুব মজা। ডা. দিলীপ খেলেন না। আমরা দুজনে তৃপ্তির সাথে খেলাম।
আমার কলকাতা অবধি টিকিট কাটা থাকলেও রানাঘাট নেমে ট্রেন বদলে কল্যাণী চলে এলাম। ফারুক আহমেদের বহরমপুরের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু তিনি যেতে পারেননি। ফলে আমাকেই কল্যাণী আসতে হলো। ফারুক আহমেদ আগে থেকেই স্টেশনে অপেক্ষা করছিলেন। তার স্কুটিতে চেপে ওর বাসায় গেলাম। বাসায় ব্যাগ রেখে আমাকে নিয়ে ফারুক কল্যাণী শহর ঘুরলেন। এর আগেও যতবার গিয়েছি ততবারই তিনি কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়সহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো দেখিয়েছেন। ঘন্টা দুয়েক কল্যাণী কাটিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। গন্তব্য দমদম এয়ারপোর্ট। সেখান থেকে ত্রিপুরার আগরতলায়। ফারুক আহমেদ আমাকে ট্রেনে তুলে দিয়ে গেলেন। আমার ৬.৫০ মিনিটে আগরতলার ফ্লাইট। আমি পাঁচটার মধ্যে দমদম এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেলাম। গন্তব্য ত্রিপুরার আগরতলা বইমেলা।
আমি যখন দমদম এয়ারপোর্টে বসে অবসর কাটানোর জন্য ফেসবুক দেখছি ঠিক তখন কবি গোবিন্দ ধরের ফোন এলো। গোবিন্দ ধর ত্রিপুরার একজন স্বনামধন্য কবি, লেখক, শিক্ষক এবং প্রকাশক। স্রোত প্রকাশনীর কর্ণধার তিনি। তিনি জানতে চাইলেন- আমি কোথায়?
আমি বললাম- দমদম এয়ারপোর্টে।
তিনি বললেন- আপনার মেসেঞ্জারে একটা মেসেজ দিয়েছিলাম। আপনি বোধহয় দেখেননি।
আমি বললাম- কী মেসেজ?
উনি বললেন- একটু মেসেঞ্জার চেক করেন।
আমি মেসেঞ্জার চেক করলাম। দেখলাম অনেকদিন আগেই তিনি আমাকে একটি মেসেজ দিয়েছিলেন। ২৮ মার্চ ৪১তম আগরতলা আন্তর্জাতিক বইমেলায় তার একটি অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠানে তিনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। আমি আগরতলায় যাচ্ছি জেনে তিনি আশ্বস্ত হলেন।
ঠিক সন্ধ্যা ৬.৫০ মিনিটে এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান আকাশে উড়লো। ঘন্টা খানেকের পথ। কোথায় থাকবো আগে থেকে সেটা ঠিক করা ছিল না। ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাকে অনেক হোটেলে নিয়ে গেল। কোথাও সিট খালি নেই। রামজি নামে একটা হিন্দু হোটেলে সিট পাওয়া গেল। অগত্যা সেখানেই উঠলাম। রাতটা তো কাটাতে হবে। সকাল হলে দেখা যাবে কী করা যায়!