সংহতি ঢাং, বড়জোড়া : বেশ কয়েক বছর ধরে কলকাতার সেরা পুজো কমিটি গুলিকে নিয়ে সরকারিভাবে আয়োজিত হচ্ছে বাঙালির শ্রেষ্ঠ শারদীয়া উৎসবকে কেন্দ্র করে দুর্গা পুজো কার্নিভাল। আমন্ত্রিত পুজো কমিটি গুলি তাদের নিজস্ব ঢঙে ট্যাবলো সাজিয়ে দৃষ্টিনন্দন সভাযাত্রা সহকারে কলকাতার রাজপথে অনুষ্ঠিত কার্নিভালে অংশ নেয়। রাজ্য সরকারের প্রধান ব্যক্তিত্বরা ছাড়াও মন্ত্রী ও প্রশাসনিক কর্তা ব্যক্তিদের সঙ্গে দেশ-বিদেশের অতিথিরা রাস্তার দুপাশে বসে কলকাতার পুজো এবং শারদীয়া উৎসব উপভোগ করেন। ইউনেস্কো কলকাতার পুজোকে হেরিটেজ ঘোষণা করার পর উন্মাদনা আরো বেড়েছে। কলকাতার এই পুজো কার্নিভাল নিয়ে গোটা রাজ্য যখন আনন্দে উদ্বেল তখনও কিন্তু বড়জোড়ার পুজো কার্নিভাল বাঁকুড়া ছাড়া রাজ্যবাসীর কাছে অন্তরালেই থেকে যায়। অথচ এখানের পুজো কার্নিভাল শতাব্দী প্রাচীন। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এমন সৌহার্দের কার্নিভাল পৃথিবীর আর কোথাও হয় না বলেই দাবি বড়জোড়া ষোলআনা কমিটির । তাদের দাবি ৩০০ বছরের প্রাচীন এই গ্রামীন কার্নিভাল কলকাতার আধুনিক কার্নিভালকে অনায়াসে টেক্কা দিতে পারে। কলাবউ স্নান, দোলা নিয়ে আসা থেকে দশমীর বিসর্জন সবেতেই বাঁকুড়া জেলাকে এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছেন বড়জোড়ার পুজো কমিটি গুলি। এখানের ষোলআনা কমিটি এই কলাবউ স্নান থেকে বিসর্জনের শোভাযাত্রা পরিচালনার দায়িত্বে থাকে। কোনো রাজনৈতিক মতভেদ এখানে খাটে না। সব দলের সমান অংশীদারিত্ব থাকে আমজনতার কাছে। এবার ষোলআনা কমিটির তত্ত্বাবধানে উল্লেখিত পর্বের পারিবারিক ও সর্বজনীন মিলে বড়জোড়াতেই ৩২ পুজো হয়েছে। ষোলআনা কমিটির ম্যানেজার প্রণব মন্ডল বলেন, পুজো পরিচালনার দায়িত্ব আমাদের নেই। তবে কলাবউ স্নান থেকে দোলা নিয়ে আসা এবং বিজয়া দশমীর ঘট বিসর্জন থেকে প্রতিমা নিরঞ্জন পুরোটাই ষোলআনা কমিটির তত্ত্বাবধানে হয়ে থাকে। এর জন্য কৃতিত্ব আমাদের কারোর নেই। আমাদের পূর্ব পুরুষেরা যে পথ দেখিয়ে গেছেন আমরা সেই পথ অনুসরণ করছি মাত্র। তিনি বলেন, সেই মল্লরাজাদের সময়কাল থেকেই এখানে জনপদ গড়ে ওঠে। বড়জোড়ার খাঁ পরিবারের পুজো এবার ৫২০ বছর পার করল বলে দাবি। চ্যাটার্জি, মুখার্জি, মন্ডল, পাল পরিবারের পুজোও ৩০০ বছরের অধিক প্রাচীন। প্রণব মন্ডল বলেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে সৌভ্রাতৃত্বের সঙ্গে পুজো কমিটিগুলির একই সাথে একই পুকুরে ক্লাবউ স্নান থেকে প্রতিমা বিসর্জনের শোভাযাত্রা পরিচালনা করেছিলেন আমরা পরম্পরা মেনে সেই ধারা বজায় রেখে চলেছি। তিনি জানান, রীতি মেনে এই ৩২ টি পুজো কমিটি বড়জোড়া রাজারবাঁধে একে একে শোভাযাত্রা সহকারে এসে কলাবউ স্নান করিয়ে দোলা নিয়ে যায়। বিজয়া দশমীর ঘট বিসর্জন ওই পুকুরেই একই নিয়মে দেওয়া হয়। তারপর বড়জোড়া বিজয়া ময়দানে দুপুর থেকে এক এক করে পুজো কমিটিগুলি তাদের প্রতিমা নিয়ে আসেন।
বড়জোড়া চৌমাথার পশ্চিম প্রান্তে বিজয়া ময়দান ও হাইস্কুল মাঠের বুক চিরে বেরিয়ে গেছে শিল্পাঞ্চলের বড়জোড়া-দুর্লভপুর শিল্প করিডোর। বেলা ৩ টা থেকে এই ব্যস্ততম সড়ক পথটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় বিসর্জনের কারণে। সমস্ত যানবাহনকে অন্য পথে ঘুরিয়ে দেওয়া হয় এই সময়। বড়জোড়ার বিধায়ক অলক মুখার্জি বলেন, বেলা ৪ টার সময় মন্ডল পাড়ার প্রতিমা শোভাযাত্রা সহকারে বিজয়া ময়দানে আসে প্রথম। রাত সাড়ে ১২ টায় শেষ প্রতিমা নিয়ে আসেন শিবতলা পুজো কমিটি। সমস্ত প্রতিমা সারিবদ্ধ ভাবে বিজয়া ময়দানে নামানো হয়।
মহিলাদের মধ্যে চলে আরেক প্রস্থ সিঁদুর খেলা। বিজয়া ময়দান ও হাইস্কুল মাঠে তখন উপচে পড়া ভিড়। প্রশাসনের দাবি প্রায় ৩০ হাজার লোক জমায়েত হয়েছিলেন বিসর্জন দেখতে। কমিটিগুলির দাবি রাত যত বেড়েছে মানুষের স্রোত বিজয়া ময়দানে এসে আছড়ে পড়েছে। তাদের দাবি দর্শনার্থীর সংখ্যা ৫০ হাজার ছাড়িয়ে গেছিল। রাত ১ টার সময় শুরু হয় বাজি প্রদর্শনী । প্রায় ১ ঘন্টা ধরে রং-মশাল ও আতশবাজির প্রদর্শনীতে বড়জোড়ার আকাশ ভরে উঠেছিল। তারপর ক্রেনের সাহায্যে এক এক করে প্রতিমা নিরঞ্জন করা হয় রাজারবাঁধে।
বিধায়ক অলক মুখার্জি বলেন, আমাদের এই ঐতিহ্যবাহী শোভাযাত্রা সহকারে সৌভ্রাতৃত্বের বিসর্জনকে যদি কার্নিভাল বলা হয় তাহলে এই কার্নিভাল যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে। তাহলে শারদীয়া উৎসবে এই বড়জোড়াই বোধহয় কার্নিভালের পথ পদর্শক। তিনি পুলিশ ও প্রশাসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এত জনমানুষকে যেভাবে সামাল দিয়েছে পুলিশ ও প্রশাসন তা অভিনন্দন যোগ্য । তাদের সজাগ নজরদারি কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা যেমন ঘটতে দেয়নি তেমনি কোনো দুর্ঘটনাও ঘটেনি।