ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম : কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে রচিত ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ একটি সম্পাদিত গ্রন্থ। কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক ফারুক আহমেদ গ্রন্থটি সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী প্রকাশনা সংস্থা ‘উদার আকাশ’ প্রকাশন থেকে। আমরা জ্ঞাত যে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম যুগের প্রেক্ষিতে আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। তাঁর ‘বিদ্রোহী’ কবিতার বিষয়বস্তু পাঠ করলে সহজেই তা বোঝা যায় তিনি কেন আজও প্রাসঙ্গিক। আজ শতবর্ষ পরে এসেও তাঁর এই কবিতাটির বর্ণিত আবেদনগ সংগত হিসেবে দেখা দিয়েছে। যা যুগের চলমান বাস্তবচিত্রের প্রতিফলন। বাংলা, বাঙালি, বাঙালিত্ব এবং সামাজিক সম্প্রীতি নিয়ে তিনি যে ভাবনার সম্মিলন সৃষ্টির মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন তা আজও অমর কীর্তি হিসেবে জ্বাজল্যমান। তাঁর সেই ভাবনার সম্মিলনকে একটি ফ্রেমে তুলে আনবার আন্তরিক প্রচেষ্টা ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থটির সারকথা। বাঙালির যাপিত ভাবনা ও সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখার নিমিত্তে কবি নজরুল ইসলাম আজীবন কলম চালিয়েছেন। বাকশক্তি হারানোর পূর্ব পর্যন্ত আবহমান বাংলায় সামাজিক সম্প্রীতির বন্ধনকে অটুট রাখার নিমিত্তে একজন কলম সৈনিক হিসেবে তিনি লড়ে গেছেন। তাঁর সেই লড়াইয়ের চিত্র যেন আরও ধ্রুব সত্যে রূপ পেয়েছে যুগের বাস্তবতায়। সেই ধ্রুব সত্যের অভীপ্সা ও বাস্তবতা গ্রন্থটির বিষয়ভাবনা।
ব্যক্তিগতভাবে কবি নজরুলের প্রত্যাশা প্রাপ্তির আবেদন কখনো নিজের জন্য ছিল না। তিনি কখনো নিজেকে নিয়েও ভাবতেন না। তাঁর নিজের কোনো কথা নেই। তাঁর কথা আপামর জনসাধারণের কথা। ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষুধা যেন তাঁর নিজের ক্ষুধা। বঞ্চিতের বেদনাগুলো তাঁর নিজের বেদনা হিসেবে দেখা দিত। মানুষের মাঝে বিভেদ সৃষ্টি তিনি মোটেও সহ্য করতে পারতেন না। একজন মানুষ মার খেলে হিন্দু না মুসলিম মার খেয়েছে তা নিয়ে ভাবতেন না। তাঁর কাছে একজন মানুষ মার খেয়েছে সেটিই ছিল ভাবনার বিষয়। এমন অন্তর্নিহিত রূপ নজরুল সাহিত্যের প্রাণশক্তিকে সঞ্চারিত করেছে। যা পরম সৃষ্টির শিল্পনৈপুণ্যে দেখা যায়। তাই সমকালীন উত্তাপ আর উত্তেজনাকে প্রশমিত করার সুপ্ত অনুষঙ্গগুলো গ্রন্থটিতে আভাসিত হয়েছে। ‘বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম’ গ্রন্থে উভয় বাংলার খ্যাতনামা তিরিশ জন প্রাবন্ধিকের শেকড় সন্ধানী প্রবন্ধসমূহ যাত্রার প্রতিধ্বনি হিসেবে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেছে। গ্রন্থে স্থান পাওয়া মননশীল ও যুক্তিনিষ্ঠ প্রবন্ধগুলো নজরুল বিষয়ক তথ্য উপাত্ত আহরণে পৌরুষদীপ্ত তলদেশকে স্পর্শ করেছে। ফলে কবি নজরুলকে স্বল্প পরিসরে একটি পর্বে জানার জন্য গ্রন্থটি যেমন প্রয়োজনীয় তেমনই অপরিহার্য।
কবি নজরুল তাঁর রচিত যে কবিতাটির জন্য সমকালে অনায়াস প্রসিদ্ধি লাভ করেছিলেন, সেই কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী’। সময় বিচারে ২০২২ খ্রিস্টাব্দ কবিতাটি রচনার শতবর্ষ।
সে কারণে গ্রন্থে কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ স্থান পাওয়ায় গ্রন্থের আবেদন বৈশ্বিক বাস্তবতাকে স্পর্শ করেছে। ফলে উদারনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে গ্রন্থটি শৈল্পিকতার দিক থেকেও অনুশীলনযোগ্য। ভৌগোলিক ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুল ইসলামকে বিচার করলে দেখা যায় কবির সঙ্গ ও প্রসঙ্গ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক। কেননা মানুষের সুস্বপ্ন, স্বাধীনতা, মানবপ্রেম, ধর্মীয় সম্প্রীতি ও কৃত্রিম বৈষম্য দূরীকরণে আদর্শের প্রতিষ্ঠা তিনি স্থাপন করে গেছেন। ফলশ্রুতিতে সাম্রাজ্যবাদী, মুনাফালোভী, অর্থনৈতিক বেনিয়া, নিরঙ্কুশ ভোগবাদী এবং মানুষের মাঝে ভেদাভেদ সৃষ্টিকারী কায়েমি শক্তির স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী নজরুলকে দাবিয়ে রাখার জন্য নানা তৎপরতা চালায়। এরপরেও কবি তার সৃষ্টির মধ্য দিয়ে আদর্শিক ও উদারনৈতিক কারণে একজন প্রিয় মানুষ ও কবি হিসেবে উজ্জ্বল নক্ষত্র।
গ্রন্থে বর্ণিত শিরোনামগুলোর সরল ও প্রাঞ্জল উপস্থাপনা কালের নিদর্শন হিসেবে বিবেচ্য। সেই সাথে বিম্বিত প্রবন্ধসমূহের ভাষা দুর্বোধ্যতার বেড়াজালে নিপতিত নয়। পাঠক মাত্রই গ্রন্থপাঠে নির্যাস নিতে সক্ষম। এমনকি আকর গ্রন্থ হিসেবে মৌলিকতার দাবিদার। তবে নজরুলক নিয়ে শেষকথা বলে কিছু নেই। কালের যাত্রায় সব কিছুই অনন্ত। এমন ক্ষণজন্মা মানুষকে নিয়ে সৃষ্টির প্রয়াস শেষ হওয়ার নয়। সমাজে অসাম্য ও ভেদজ্ঞান দূর করতে কবির যে প্রাণপণ প্রচেষ্টা, সে প্রচেষ্টা অনাগত সৃষ্টির ভাববৈচিত্র্যে চলমানতায় যুগান্তকারী। “বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম” মূল্যবান প্রবন্ধ সংকলনে কলম ধরেছেন আবুল হাসনাত, জয়ন্ত ঘোষাল, সুমিতা চক্রবর্তী, মীরাতুন নাহার, মইনুল হাসান, চৈতী চক্রবর্তী, সোনিয়া তাসনিম খান, সোমঋতা মল্লিক, কামরুজ্জামান, আবদুস সামাদ, অনল আবেদীন সহ ৩০ জনের লেখায় সমৃদ্ধ প্রয়াস।
বিস্তীর্ণ আকাশ জুড়ে কাজী নজরুল ইসলাম
সম্পাদনা ফারুক আহমেদ
উদার আকাশ
ঘটকপুকুর,
ভাঙড় গোবিন্দপুর-৭৪১২৩৫,
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা,
পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
মূল্য: ২৫০.০০