১২ই শ্রাবণ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
Advertisement

ছবিওয়ালার গল্প৬৫

অশোক মজুমদার : আজ শনিবার ঈদ উল ফিতর। পবিত্র খুশির ঈদ। প্রতিবার কলকাতার একটা করে নতুন ঈদের নামাজের ছবি তুলতাম। নাখোদা মসজিদ থেকে শুরু করে রেডরোড, বড়বাজার টিপু সুলতান শেষে ময়দানে আফগানদের নাচ দিয়ে শেষ করতাম। কেন জানিনা ঈদের ছবি তুলতে আমার খুবই ভালো লাগতো।

 

Advertisement

যেহেতু শনিবার হলেই আমি *ছবিওয়ালা*…. ওই আলুওয়ালা, পটলওয়ালা, মুদিওয়ালা, মাছওয়ালার মত। যদিও তারা পরিশ্রমী কিছু একটা বিক্রি করে। আমি সেদিক থেকে বাতেলা বিক্রি করি বা বাতেলা মারি। তাই আজকে ঈদের দিনে ছবিওয়ালার পুরোনো স্মৃতির কথা খুব মনে পরছে। আজ সেই গল্পই আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

 

Advertisement

মাফ করবেন লেখাটা প্রায় উপন্যাসের মত হয়ে গেছে। আসলে লিখতে লিখতে বহু কিছু মনে পরে যায়। একটু সময় নিয়ে পড়বেন।

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

জানবাজারে রানী রাসমনির লাল রংয়ের বিশাল বাড়ির মাঝখানে একটা লোহার বড়ো গেট। ওই গেটে ঢুকে প্রথম বাঁদিকে একটা ছোট্ট ল্যাব। মালিকের নাম ইকবাল। ওটা ছেড়ে সোজা গিয়ে যেখানে ধাক্কা খাচ্ছে সেই ল্যাবের কোন নাম না থাকলেও তৃপ্তি ও জগদিশদাকে চিনতেন না কলকাতা শহরের এমন কোনো চিত্র সাংবাদিক ছিলো না।

Advertisement

 

৮০..৯০..২০০০..শতকের কলকাতার সব চিত্র সাংবাদিক সে ফ্রীল্যান্স হোক কি নিয়মিত স্টাফ এই দুটো ল্যাবের কথা জানতেন। সেই সময় সাদাকালো নেগেটিভে আমরা ছবি তুলতাম দরকার পড়লে কালার ফিল্ম, মোট কথা সবকিছু ল্যাবেই ডেভলপ করতে হতো। এই ল্যাবের মালিক ছিল সুশীলদা। তার একটা ক্যামেরার দোকান ছিল।

Advertisement

 

আমরা সব চিত্রসাংবাদিকরা সুশীলদার কাছে ঋণী। এক কথায় ধারবাকি রেখে ক্যামেরা, লেন্স, ফ্ল্যাশগান নিতে পারতাম। তৃপ্তির হাতের ডেভলপ আর জগদীশদার প্রিন্ট আমরা কেউ ভুলিনি। কত আবদার ছিলো আমাদের। তৃপ্তি জগদীশদার ল্যাবে ভিড় থাকলে আমরা ইকবালের কাছেই যেতাম। সেও কম যায় না। সব সময় মুখে পান রাখা লাল দাঁতগুলোতে হাসি লেগেই থাকতো।

Advertisement

 

সেই সময় দীর্ঘদিন আজকাল পত্রিকার কোন নিজস্ব ল্যাব ছিল না। দিনের পর দিন জগদীশদা, তৃপ্তি, ইকবাল আমাদের আবদার মিটিয়েছে। এমনকি মনা চৌধুরী( টাইমস অফ ইন্ডিয়া ) সহ বহু স্বনামধন্য চিত্র সাংবাদিকরা এখানে এসে কাজ করতেন। সাদা কালোর সেই যুগ আমাদের কাছে স্বপ্ন হয়ে গেলো। সত্যি বলছি ম্যানুয়াল জীবনটাই মানুষকে তরতাজা রাখতো।

Advertisement

 

সাহিত্যিক সাংবাদিক গৌড়কিশোর ঘোষের নিজের চিন্তাভাবনায় তৈরি আজকাল পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর কলকাতায় ছেলেমেয়েদের ভিতরে সাংবাদিক হবার জোয়ার আসে। গৌড়দার জন্যই বলতে গেলে বাংলা সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত খুলে যায়। আধুনিক শিক্ষিত ছেলেমেয়েরা রিপোর্টার ফটোগ্রাফার হবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ে।

Advertisement

 

ছবির ক্ষেত্রে আজকাল একটা বিপ্লব এনে দিয়েছিল। শুধু আমরা কেন এখনকারও বহু ছেলেমেয়েরা ছবি তোলা শুরুই করে আজকালে প্রকাশিত ছবি দেখে। খবরের বাইরে গিয়ে একেবারে নতুন চিন্তাধারায় ছবি তোলার চোখ গৌড়দাই তৈরি করে দিয়েছিলেন। কোথায় তখন সাদা বাড়ির কালো গ্রিল। রাজনৈতিক ফিতে কাটা ও ইনসিডেন্স ছাড়া ছবি নেই। দামী দামী ক্যামেরা আর লেন্সে আর ক্যাপশনে স্টাফ ফটোগ্রাফারের তোলা প্রফেশনাল ছবি।

Advertisement

 

বলতে দ্বিধা নেই ওই সব ক্যামেরা লেন্স দেখে আমাদের জিভে জল আসতো। পকেটে সরকারি কার্ড নিয়ে আনন্দবাজার হাউসের ফটোগ্রাফারদের সেকি হম্বি তম্বি। যদিও পরে আমরাও হাতে হাত ধরে কাজ করেছি শিখেছি। তারাদা, আলোকদা, নিখিলদা, বিশুদা, তপনদা, দেবিদা এরা সত্যি শুধু বাংলা না ভারতের সেরা ফটোগ্রাফার ছিলো।

Advertisement

 

গৌড়দা আজকাল পত্রিকায় কিন্তু কোন ফটোগ্রাফারদের চাকরি দেননি। গৌড়দা বলতেন, “ফটোগ্রাফারদের চাকরী দিলেই ওদের হাতে ভালো কাজ বেরোবে না।” আমাদের ভেতরে এটা নিয়ে ক্ষোভ থাকলেও পরে বুঝেছিলাম চাকরি করা চিত্রসংবাদিক আর ফ্রিল্যান্স চিত্র সাংবাদিকদের ভেতরে একটা তফাৎ থাকে। এটাতো বাস্তব যে পৃথিবীতে ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফারদের দাম অনেক বেশি। তারা টাকাও বেশি পায়। ব্যতিক্রম শুধু আমাদের এখানে। কম টাকা দিয়ে ফ্রিল্যান্সারের যৌবনটা নিংড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলা হয়।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

এখন বেশি করে এই কৌশল নিচ্ছেন খবরের কাগজের মালিকরা। আর সবথেকে দুঃখের ব্যাপার মালিকদের সাথে সাথ দিয়ে ভালো মাইনে পাওয়া বাতেলা দিয়ে বেড়ানো এক শ্রেণীর রিপোর্টার এমন কি হাতে গোনা ফটোগ্রাফারও আছে এই অন্যায়ে। খাটিয়ে নাও যৌবনটাকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দিয়ে যত কাজ করাবে, করাও। কাজ যতদিন তোমাদের মাইনে ততদিন। যাইহোক এই কথা বললে অনেক কথা বার হবে, হয়তো বিতর্ক বহুদূর যাবে। আজ ছবিওয়ালার গল্পের প্রেক্ষাপট অন্যরকম তবু একদিন হাত খুলে জানাবো।

Advertisement

 

পান খাওয়া লাল দাঁত আর হাতের দশটা আঙুল ডেভলপ করে করে একেবারে খয়েরি কালো রং হয়ে যাওয়া ইকবালকে একবার এরকমই ঈদের কয়েকদিন আগে আমি বলি, “ইকবাল তোমার বাড়িতে এবার খেতে যাব।”

Advertisement

 

ইকবাল হেসে বলে, “আপনি সত্যি যাবেন অশোকদা?”

Advertisement

 

আমি বললাম, “হ্যাঁ যাবো। কেন তোমার আপত্তি আছে?”

Advertisement

 

ইকবাল বলল, “না না, সে আমার ভাগ্য।”

Advertisement

 

যথারীতি ঈদের দিন দুপুরে রিপন স্ট্রিটে ইকবালের বাড়িতে হাজির হই। ওর ছেলের জন্য ক্যাডবেরি আর ওদের জন্য রসগোল্লা হাতে নিয়ে। বস্তির এ গলি ওই গলি ইকবালের নাম করতে করতে ওর বাড়ি পৌঁছে যাই। ওর ছেলে টুকটুকে ফর্সা, রঙিন পাজামা পাঞ্জাবী মাথায় টুপি….কি মিষ্টি দেখতে। গাল টিপে হাতে ক্যাডবেরি দিলাম। মিষ্টির হাঁড়ি নিয়ে ওর বউ কোথায় জানতে চাইলাম।

Advertisement

 

আগে থেকেই দরজার জীর্ণ পর্দার সাথে কালো বোরখা পড়ে মুখ ঢাকা অবস্থায় যে মহিলা দাঁড়িয়ে আছে তাকে সত্যিই চেনা যায় না। বহিন বলে কাছে আসতে বলি। ও এসে হাত জোড় করে নমস্কার করে। কালো বোরখায় মেহেন্দি পরা ফর্সা হাতদুটো খুব সুন্দর দেখতে লাগছিল।

Advertisement

 

আমি ছবিওয়ালা তখন এই ভাবেই সব কিছু দেখতাম। আসলে তখন সব ভালোলাগা এমন ছিল খালি চোখে কিছু দেখলেও লোহার ভিউ ফাইন্ডারের দিয়ে দেখাটা মনে পরতো।

Advertisement

 

খুব গরম পাখা চললেও ইকবাল তালপাতার পাখায় হওয়া দিতে শুরু করলো। বসে বসে নানান গল্প মজা হাসাহাসি চলছে। কিছুক্ষন পর পর্দা ফাঁক করে ইকবালের বউ এর ইশারায় ইকবালকে জানতে চাইলো, “এখন খেতে বসবো কিনা ?”

Advertisement

 

ইকবাল আমার দিকে তাকাতেই বললাম, “দাও দাও। আজ কব্জি ডুবিয়ে খাবো।”

Advertisement

 

স্টিলের থালায় উঁচু করে ভাত চলতি কথায় যেটা আমরা বলি বেড়াল ডিঙোতে পারবে না। মনে মনে হাসলাম। থালার পাশে নানা ধরনের বাটি। দুটো কলাই এর বাটিও দেখলাম।

Advertisement

 

মনে পরলো গ্রামে মা এই কলাইয়ের বাটিতে দুধ মুড়ি খেতে দিত। খাওয়া শেষে বাটিতে জল ঢেলে দিত। চিনির পিঁপড়েগুলো ভেসে উঠতো। খেতে চাইতাম না বলে মা বলতো, “খেয়ে নে তাড়াতাড়ি সাঁতার শিখতে পারবি। ”

Advertisement

 

তখন এতো স্টিল ছিলইনা। প্রতি গরীব ঘরে কলাইয়ের বাটি থাকবেই। একমাত্র অতিথি এলে বিয়েতে পাওয়া কাঁসার বাসন কয়েকটি দেখতে পেতাম।

Advertisement

 

আমি বসতে গিয়ে টের পেলাম আসন বলতে ইকবালের বউয়ের একটা পুরনো রঙিন শাড়ি বেশ পরিপাটি করে ভাঁজ করা। অবাক হইনি কারণ গ্রামের বাড়িতে আমার মাও ছেঁড়া কাপড় দিয়ে দরজা জানলার পর্দা করতো। পুরনো কাপড় দিয়ে কাঁথা বানাতো। ভালো লাগছে এই ভেবে যে প্রতি মুহূর্তে ইকবাল আমায় গ্রামে ফিরিয়ে দিচ্ছে।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

যে পরিমাণ ভাত আমাকে দিয়েছে দুদিন খেয়েও শেষ করা যাবে না। তার সঙ্গে মাছ, মাংস, ডাল, সবজি, পাঁপড় ভাজা, চাটনি মিষ্টি। বাপ রে বাপ। ছোট থেকেই আমি পেটুক কিন্তু তাই বলে এত খাওয়া সম্ভব নয়।

Advertisement

 

আমি ইকবালের বউকে বললাম, “এক্সট্রা থালা আর হাতা দাও আমায়। এত খেতে পারবো না।”

Advertisement

 

ইকবাল কিন্তু জোরাজুরি করছে, “খান দাদা খান।”

Advertisement

 

ওর বউ থালা হাতা দেবার সময়ও দেখলাম

Advertisement

কাচের চুড়ি পড়ে পুরো হাতে সুন্দর করে মেহেন্দি করা।

 

Advertisement

খাওয়া শুরু করার পর দেখছি মাটন চিকেন থাকলেও একটা পদ মিস। ইকবাল ছেলেকে নিয়ে বেঞ্চে বসে আছে। ওর বউ পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে।

 

Advertisement

আমি বললাম, “ইকবাল ওইটা কোথায়?”

 

Advertisement

ইকবাল বললো, “অশোকদা সব দিয়েছি।”

 

Advertisement

আমি বললাম, “না না ওইটা দাওনি। ওটা কি তোমরা খাও না ?”

 

Advertisement

এবার ইকবাল বুঝে দাঁড়িয়ে জোড়হাত করে বলল….”অশোকদা, আমরা কোন অন্য ধর্মের অতিথিকে ওই মাংস দিই না। কোরানে আছে। আমাদের ধর্মে ওটা পাপ হবে।”

 

Advertisement

আমি বললাম, “আরে আমি তো সব খাই তুমি জানো।”

 

Advertisement

“অশোকদা, ওটা আপনি আপন মর্জিতে নিজে খান। কিন্তু আমরা কোনো অতিথিকে ওটা দিতে পারি না।”

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

‘ঠিক আছে তোমার অতিথি ওটাই খেতে চাইছে, তাও তুমি দেবে না ?”

 

Advertisement

আমার নাছোড়বান্দায় ইকবাল ওর বউকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল। তারপর বাটি হাতে নিয়ে এসে বললো, “অশোকদা, আমার বউ কিছুতেই রাজি না। অনেক বুঝিয়ে নিয়ে এলাম। বললাম আপনি নিজামে গেলেই বিফ খান। আসলে অন্য ধর্মের মানুষকে আমরা বিফ দিতে পারিনা। আল্লাহ পাপ দেবে।”

 

Advertisement

আমি হেসে বললাম, “আমি তো সবই খাই।”

 

Advertisement

ইকবাল অবাক হয়নি কারণ ও আমার এগুলো জানতো। উল্টে ওই আমায় মাঝেমধ্যে বলতো, “গরমে এত বিফ খাবেন না।” কিন্তু ওকে কি করে বোঝাই এত কম পয়সায় প্রোটিন পেট ভরে যাবার মতন আর কি বা খাই।

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

যাইহোক সেদিন ওর বউ খুব অবাক হয়ে গুটিগুটি পায়ে ইকবালের পাশে বসে এরকম আজব অতিথিকে দেখতে লাগলো। আমি কিন্তু চিকেন, মাটন,বিফ পুরোটাই শেষ করলাম। তখন খেতেও পারতাম। মাঝেমাঝে বোরখার একটা পার্ট সরিয়ে ইকবালের কানে কানে কথা বলছিলো ওর বউ। আমার চোখ পরতেই কিন্তু বোরখা নেমে যাচ্ছিল। কি একটা নাম বলেছিল ওর এখন মনে পরছে না।

 

Advertisement

এবার বেরোবার পালা। ছেলেটাকে আদর করে বেরোবার মুখেই আমি অবাক হয়ে যাই দেখি ইকবালের বউ বোরখা তুলে জোড়হাত করে দাঁড়িয়ে আছে। নমস্কার করে বললো, “দাদা আবার আসবেন।”

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

“হ্যাঁ বহিন আসবো। তখন যেন না বলতে হয় বিফ দাও।”

Advertisement

 

একগাল হেসে উত্তর ছিল…”হ্যাঁ দাদা।”

Advertisement

 

আমি কখনও দেখিনি কোনো মুসলিম কাওকে জোর করে কিংবা না বলে বিফ খাওয়াচ্ছে। গ্রামেগঞ্জে বা শহরে লেখা থাকে ‘মুসলিম হোটেল।’ সেখানে বিফ থাকে। সবাই জানে সেটা। চিকেন মটনও থাকে। কখনও সেখানে মটন বলে বিফ খাওয়ায় না। কিন্তু এই যে ‘হিন্দু হোটেল’ বলে যা লেখা থাকে সারা পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতবর্ষে আমার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি একমাত্র হিন্দুরাই অনেক জায়গায় কুকুর বা বিফ কাস্টমারদের খাইয়েছেন। বহু হোটেলে এটা হয়েছে। ধরাও পরেছে। এখানে এসব অবান্তর তাই বিস্তারিত আলোচনায় গেলাম না।

Advertisement

 

সাদা বাড়ির কালো গ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় কাজ করার সময় একবার আমি ঈদের তিন চারদিন আগে নাখোদা মসজিদের পেছনের দিক সহ বিভিন্ন বাড়ির ছাদ দেখে আসতাম। কেয়ারটেকার বাড়ির মালিক সবার সাথেই কথা বলে রাখতাম যেন আমি ঈদের দিন উপরে উঠতে পারি।

Advertisement

 

এইরকমই একবার নাখোদা মসজিদের পেছনে এক বাড়ির ছাদে উঠেছিলাম। ওই ছাদে বেশ কিছু ঘরে আফগানিস্থান থেকে আসা শালওয়ালারা থাকতো। তারা ছাদের উপরেই পঁচিশ থেকে ত্রিশজন নামাজ পড়তো। ওদের নামাজের সামনেই পুরো নাখোদা মসজিদ। আমি সেই ছবি তুলেছিলাম আর আনন্দবাজারে তা ছাপাও হয। অনেক সিনিয়র দাদা বন্ধুরা জানতে চেয়েছিল কোথা থেকে তুলেছি। যদিও আমার তখন বড়ো ওয়াইড লেন্স ছিলনা। মাত্র ২৪ ওয়াইড। আরো বড় লেন্স থাকলে ওদের নামাজ পড়ার সাথে নাখোদা মসজিদের সামনের পুরোটাই আসতো।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

ওই ফ্ল্যাটের ওপর সব বনেদি মুসলিম পরিবার থাকে। ঈদের দিন আমাকে ঘরে নিয়ে যেত। একটা পরিবার মনে আছে তাদের দুটি ছোট্ট মেয়ে একজন ষষ্ঠ ও অন্যজন অষ্টম শ্রেণীতে পড়তো। স্কুল লরেটো, ফলে তারা এমন ভাবে ইংরেজিতে আলাপ করছিল যে আমি ভিরমি খেয়ে তোতলাতে শুরু করি। তার ভিতরে আবার ক্যামেরা নিয়ে নানান প্রশ্ন। কি করি ভাবতে ভাবতে খুব কায়দা করে বললাম, “তোমাদের বাবা বলছিলো কলকাতাতেই তোমাদের জন্ম। তোমরা কি বাংলা বলতে পারো ?”

Advertisement

 

বললো, “হ্যাঁ আংকেল। স্কুল ছাড়াও আমরা অনেক সময় বাড়িতেও বাংলা বলি।”

Advertisement

 

উফফফ একটু প্রাণ এলো শরীরে। সেদিন দুপুরে ওখানেই খেতে বললো। সম্ভবত ওটা বকরি ঈদ ছিলো। আমি বিরিয়ানি খাওয়ার লোভেই ওদের বাড়ি যাই। মনে আছে রুপোর থালায় আমাকে বিরিয়ানি দেয়।

Advertisement

 

সেদিন মেয়ে দুটো ছবি তোলার অনুরোধ করলে আমি বলেছিলাম, “একদিন এসে সপরিবারে তোমাদের ভালো করে ছবি তুলে দেব।”

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

অস্বীকার করবোনা ওদের সঙ্গে ভাব করতে চেয়েছিলাম ওদের বাড়ি খাওয়া দাওয়ার জন্য। পরে একবার ওদের পার্সোনাল অ্যালবাম আমাকে দেখায়। আমি তো অ্যালবাম দেখে রীতিমত ভয় পেয়ে যাই। দেখছি খাসির মাথা ঠ্যাং দুহাতে মাংস রক্ত নানান পোজে ছবি। যা আমাদের মেয়ে তো দূরের কথা কোনো ছেলেরাও ভাবতে পারবে না। আপনারা তো জানেন বকরি ঈদে কুরবানীর সেই ইতিহাস।

Advertisement

 

তবে ওই ছবিগুলো দেখে একটা কথা মনে হয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, “পুজোতে পাঁঠাবলি দেখতে। তাহলে নাকি সাহস বাড়ে।”

Advertisement

 

ঈদের দিন সকালে আমার বন্ধু ফটোগ্রাফারদের দেখতাম ক্যামেরা নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সেন্ট্রাল এভিনিউ ধর্মতলা নেমে রেডরোডের দিকে হন হন করে হাঁটতে। তারপর রেডরোড পৌঁছে হলুদ বা লাল কাপড় দিয়ে মোড়া ক্যামেরা বার করে দু তিনবার ফুঁ দিয়ে বকের মতো গুটি গুটি পায়ে ছবির সাবজেক্ট খুঁজতে। এরা সর্বদাই দল বেঁধেই থাকে। একজন কিছু তোলা মাত্রই সবাই ঝাঁপিয়ে পরতো। এদের সাবজেক্ট বেশিরভাগ সাজগোজ করা শিশু।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

ডিজিটাল ক্যামেরা মোবাইল আসার পর এখন সবাই ফটোগ্রাফার। নাচ, গান, কবিতা শেখার মতো পাড়ায় পাড়ায় ফটো ক্লাবও তৈরি হয়েছে। আগামীতে আরও হবে। কিন্তু আমার মনে হয়, আসলে ছবি আঁকা, ছবি তোলা এগুলো ভীষন ইন্ডিভিজুয়াল স্কিল। এগুলো কয়ার গ্রুপের মতো গান নাচ কবিতার মত নয়। খুব একা নিজের ভাবনায় মজে থাকতে হয়। আপনারা আবার কিছু মনে করবেন না এটা নিয়ে। এগুলো নিজের মত আলোচনা মতামতের ব্যাপার। তর্ক বিতর্ক করার কিছু নয়। আমার এই বিষয়ে কথা বলার জ্ঞান খুবই সীমিত। তবু যেটা মনে হয় বললাম।

Advertisement

 

ময়দান কাস্টমস মাঠের দিকে প্রচুর মেয়েরা নামাজ পড়তো। মাঝে একটা বিরাট আবরণ ঢাকা থাকতো তার উল্টোদিকে পুরুষরা নামাজ পড়তো। সেই ছবিটিও আজ পোস্টে আমি দিয়েছি। এখন এই নামাজটা হয় না। মুসলিম ইনস্টিটিউট হলে এখান শুধু মেয়েদের নামাজ হয়। একজন মৌলবি পর্দার আড়াল থেকে তাদের নামাজ পড়ান। খুব ভালো ছবি হয়। একটু অনুমতি নিতে হয়।

Advertisement

 

জানিনা কেন ঈদে নামাজের ছবি তুলতে আমার এক বিশেষ আনন্দ হয়।একবার এই আনন্দে রেডরোডে জমা জলে নামাজের ছবি তুলতে গিয়ে ওই নোংরা জলেই শুয়ে পড়েছিলাম। পোস্টে সেই ছবিটাও দিলাম। তারপর আমার কি অবস্থা হয়েছিল তা আপনারা বুঝতেই পারছেন।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

আজকাল পত্রিকার কুমার রায় সেই ছবি তুলেছিল। তারপর আমাকে সেটা প্রিন্ট করে পাঠিয়েছিল। কুমার আমার খুব প্রিয় ভালো চিত্র সাংবাদিক। সদ্য অবসর নিয়েছেন। বয়সে ছোট হলেও আমরা একসাথে বহু কাজ করেছি। এমন কি কলেজ স্ট্রিটের বসন্ত কেবিনে মাথা গোঁজার ঠাঁই ওই আমায় করে দিয়েছিল। মনে প্রাণে বামপন্থী ভালো ছেলে।

 

Advertisement

এখন ঈদের দিন আগের মতো আলাদা করে ছবি তোলা হয় না। এদিন মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবছর রেডরোডে যান ঈদের শুভেচ্ছা জানান। আমি সেই ছবি তুলে বাড়ি ফিরে আসি।

 

Advertisement

তবে এখনও ঈদ এলেই আমার মুসলিম বন্ধু তথা ইমরোজ, হায়দার, ইকবাল, নুর, কবির, আশাবুল এরকম অনেকে আমায় এখনো বিরিয়ানি হালিম বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। তাতে কিন্তু দুধরনের মাংসই থাকে।

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

 

Advertisement

শেষ করবো অর্চনা মজুমদারের কথা লিখে….

 

Advertisement

অর্চনা আর নেই। এন আর এস মেডিকেল কলেজে নতুন পড়ুয়া ছাত্র ছাত্রীদের কাছেই থাকেন। সব জেনেও অর্চনা কোনদিন আমাকে প্রশ্ন করেনি কেন এগুলো খাই ? আমাদের ধর্মে এটা অপরাধ। এমনকি যে থালা বাটিতে বিফ খেয়েছি সেগুলো আলাদা করে সরিয়ে রাখতেন না। ওপার বাংলায় ক্লাস থ্রি পাশ অর্চনা মজুমদার আমায় এই সাহস জুগিয়েছে খুব ছোট থেকেই। বলেছে “মানুষের জাতি একটাই সে মানুষ। তোর মনে হলে পূজা করবি। রুচি হলে খাবি। মানুষের ধর্ম মনুষ্যত্ব।’

 

Advertisement

আমি সব ধরনের মাংস খেয়েছি। কাক আর বেড়াল বাদ দিয়ে। বিফ না খাওয়া বা খাওয়া এর মধ্যে কোন কৃতিত্ব নেই। এটা পরিবেশ এবং নিজ রুচির উপর নির্ভর করে।

 

Advertisement

 

 

Advertisement

 

জানেন ছোটবেলায় দেখেছি গ্রামে মাঝেমাঝে কালো জোব্বা পরে যে মুসলিম ফকির ধনুচি হাতে বাড়ির বেড়ার ওপার থেকে মুখে কি সব বিরবির করে বলতেন। অর্চনা তাকে বেড়া খুলে দিয়ে বলতো, “ফকির বাবা, তুমি বাড়ির ভেতরে ভালো করে ধুনো দিয়ে দাও।”

Advertisement

 

তারপর তাকে নমস্কার করে পয়সা দিত। আমার বাবা পিসি এমন কি আমার মনেও প্রশ্ন থাকতো যে অর্চনা কি করে এই মুসলিম লোকটাকে বাড়িতে ঢুকতে দিতো। পরে বুঝেছিলাম ওটাই ছিল অর্চনা। আমার মা।

Advertisement

 

মা শান্তিতে ঘুমাও….আমি, নূপুর, অদ্রিজা, রিক, পিকু তোমার পাশে না থাকলেও তোমার ইচ্ছাতেই অনেক ডক্টর নাতি নাতনীর সঙ্গে সময় কাটাও।

Advertisement

 

 

Advertisement

 

আজ ছবিওয়ালার গল্পে যে মুহূর্তগুলি বললাম তারসাথেই আমার গোটা জীবনের চলাচল। এভাবেই মানুষকে সাধারণ চোখে দেখি আমি। ভরসা করি। ভালোবাসি। ছবিগুলো আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেখতে অনুরোধ করছি।

Advertisement

 

প্রচন্ড গরমের দাপট চলছে। গাছ কেটে প্রকৃতির ক্ষতি করে চলেছি আমরা। প্রতিশোধ প্রাপ্তি তো হবেই। প্রত্যেকে গাছ বসান। নাহলে ভবিষ্যত ভয়ংকর।

Advertisement

 

জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলকে ঈদ মোবারক।

Advertisement

 

ধন্যবাদ।।

Advertisement

অশোক মজুমদার।।

২২..০৪..২০২৩

Advertisement